বাংলাদেশে এখন অনলাইন জন্ম নিবন্ধন করা অনেক সহজ। ঘরে বসেই আপনি জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফরম পূরণ করতে পারেন, পরে প্রিন্ট কপি নিয়ে স্থানীয় অফিসে জমা দিলেই কাজ হয়ে যায়। এই ব্লগ-এ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ধাপে ধাপে বোঝানো হয়েছে, যাতে নতুন বাবা-মা বা প্রাপ্তবয়স্ক আবেদনকারী দু’জনই ঝামেলা ছাড়া করতে পারেন।
শুধু মনে রাখবেন, আইন অনুসারে শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করার চেষ্টা করুন। সময়মতো করলে বাড়তি কাগজপত্র ও ঝামেলা কমে যায়।
জন্ম নিবন্ধন করতে কি কি লাগে?
জন্ম নিবন্ধনের কাগজপত্র বয়সভেদে একটু আলাদা হয়। একদম নতুন জন্ম হলে সাধারণত EPI টিকা কার্ড বা হাসপাতালের কাগজই যথেষ্ট। বয়স বাড়লে অতিরিক্ত প্রমাণপত্র লাগে। যেমন স্বাস্থ্যকর্মীর প্রত্যয়ন, স্কুলের সনদ, বা বয়সপ্রমাণের মেডিকেল সার্টিফিকেট।
ঠিকানার প্রমাণ হিসেবে অনেক জায়গায় হোল্ডিং ট্যাক্স/খাজনা রসিদ চাইতে পারে। এসব তথ্য আগে থেকে গুছিয়ে রাখলে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন আবেদন দ্রুত করা যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পিতা–মাতার ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন নম্বর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিস্টেম এই নম্বর চায়। দিলে বাবা-মায়ের নাম নিজেরাই উঠে আসে এবং এডিট করা যায় না, ফলে ভুল কম হয়। তবে নিবন্ধনকারী ব্যক্তির জন্ম ২০০০ সাল বা তার আগে হলে, অনেক সময় বাবা-মায়ের নাম ম্যানুয়ালি লেখার অপশন দেখা যায়।
নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন করার নিয়ম
ধাপ ১: অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রবেশ ও অফিস/ঠিকানা নির্বাচন
আপনার ব্রাউজার দিয়ে সরকারি ওয়েবসাইট bdris.gov.bd-এ যান। সেখানে নতুন জন্ম নিবন্ধন অপশনে ক্লিক করুন।

প্রথমেই যে স্থান থেকে নিবন্ধন করতে চান সেটা সিলেক্ট করে নিতে হবে। মূলত ২টি অপশন পাবেন, জন্মস্থান এবং স্থায়ী ঠিকানা। আপনি যে স্থানে কাগজ জমা দিতে সুবিধা পাবেন, সেটাই সিলেক্ট করুন।

ধাপ ২: শিশুর পরিচিতি ও জন্মস্থানের ঠিকানা প্রদান

এবার শিশুর নাম (বাংলা ও ইংরেজি), জন্মতারিখ, লিঙ্গ ইত্যাদি দিন। নামের বানান ঠিক যেভাবে ভবিষ্যতে ব্যবহার করবেন সেভাবেই লিখুন। পরবর্তিতে এসব তথ্য পরিবর্তন করতে চাইলে “জন্ম নিবন্ধন সংশোধন” করতে হয়। যা কিছুটা ঝামেলার।
এবার শিশুর জন্মস্থানের ঠিকানা প্রদান করুন। জন্মস্থানের ঠিকানায় যেসব তথ্য দিতে হবে…
ধাপ ৩: পিতা–মাতার তথ্য প্রদান
এই অংশে পিতা–মাতার ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন নম্বর দিতে হবে। নম্বর দিলে সিস্টেম নিজে থেকেই তাদের নাম দেখাবে এবং সাধারনত পিতামাতার তথ্য এডিট করা যাবে না, এতে ভুল কম হয়।

নোটঃ যদি শিশুর জন্ম ২০০০ বা তার আগে ধরা পড়ে, তখন অনেক সময় বাবা–মায়ের নাম টাইপ করার অপশন দেখা যায়। আপনার ক্ষেত্রে যে অপশনটি আসে, সেটাই অনুসরণ করুন।
ধাপ ৪: স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা প্রদান
এবার আপনাকে বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার সকল তথ্য প্রদান করতে হবে। তবে তার আগে নিচের ছবিটির মতো “কোনটিই নয়” বাটনে ক্লিক করুন।
এবার স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা প্রদান করুন।
এক্ষেত্রে যদি জন্মস্থান এবং স্থায়ী ঠিকানা একই হয় তাহলে “জন্মস্থান এবং স্থায়ী ঠিকানা একই” বক্সে টিক দিন। এছাড়া বর্তমান ঠিকানার ক্ষেত্রেও স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা যদি একই হয় তাহলে “স্থায়ী ঠিকানা এবং বর্তমান ঠিকানা একই” বক্সে টিক দিন।
অন্যথায় স্থায়ী ঠিকানা এবং বর্তমান ঠিকানা ম্যানুয়ালি ইনপুট করে “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ ৫: আবেদনকারীর তথ্য প্রদান
এই ধাপে যিনি আবেদন করেছেন তার তথ্য দিতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্ক কেউ নিজের জন্ম সনদের জন্য আবেদন করলে “নিজ” সিলেক্ট করুন। পিতা-মাতা অথবা অন্য কোনো অভিবাবক আবেদন করলে “অন্যান্য” সিলেক্ট করে উক্ত ব্যাক্তির তথ্য প্রদান করুন।
সবকিছু সঠিকভাবে প্রদান করার পর “পরবর্তী” বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ ৬: প্রয়োজনীয় কাগজ সংযুক্তি
অনলাইনে কোথাও কোথাও কাগজ আপলোডের অপশন থাকে। যেমন EPI কার্ড, হাসপাতালের কাগজ, ঠিকানার প্রমাণ। আপনার স্ক্রিনে যা চাওয়া হবে, সেটাই দিন। না চাইলে পরে প্রিন্ট কপির সঙ্গে অফিসে জমা দিন।
ধাপ ৭: রিভিউ করে সাবমিট
সবকিছু পূরণ হলে একটি রিভিউ পেজ আসে। বানান, তারিখ, ঠিকানা, সব ভালো করে মিলিয়ে সাবমিট করুন। সফল হলে স্ক্রিনে ও কখনো SMS-এ Application ID পাবেন, এটাই আপনার মূল রেফারেন্স।
ধাপ ৮: জন্ম নিবন্ধন আবেদন পত্র প্রিন্ট
সাবমিটের সাথে সাথেই জন্ম নিবন্ধন আবেদন পত্র প্রিন্ট করার অপশন দেখাবে। এখানে খুব জরুরি একটা সেটিংস আছে, প্রিন্ট দেওয়ার সময় More settings → Headers and Footers অন রাখুন। না হলে Application ID প্রিন্টে দেখা যাবে না, পরে অফিসে সমস্যা হবে। প্রয়োজনে এই প্রিন্ট কপি পরে আবারও নেওয়া যায়।
ধাপ ৯: স্থানীয় অফিসে কাগজ জমা
অনলাইন আবেদনের পর ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন অফিসে প্রিন্ট কপি ও প্রয়োজনীয় কাগজ ১৫ দিনের মধ্যে জমা দিন। সময়মতো জমা না দিলে আবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হতে পারে, এটা মাথায় রাখুন। জমা দেওয়ার পর তারা যাচাই করে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করবে।
ধাপ ১০: সনদ পাওয়া ও যাচাই
রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে আপনি জন্ম নিবন্ধন সনদ পাবেন। চাইলে অনলাইনে everify.bdris.gov.bd-এ গিয়ে ১৭-সংখ্যার নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে সত্যতা যাচাই করতে পারেন। অনলাইন যাচাই কপি অনেক জায়গায় কাজে লাগে।
জন্ম নিবন্ধন আবেদনের বর্তমান অবস্থা
আবেদন জমা দেওয়ার পর স্ট্যাটাস জানা দরকার হলে “আবেদনপত্রের অবস্থা” পেজে Application ID ও জন্মতারিখ দিয়ে দেখতে পারবেন। এখানেই দেখাবে রিভিউ হচ্ছে, রেজিস্টার্ড, নাকি কোনো কাগজ চাওয়া হয়েছে।
সাধারণ সমস্যার সমাধান
Application ID হারিয়ে গেছে, কি করবো?
প্রথমে যে প্রিন্ট কপি নিয়েছিলেন সেখানে দেখুন। অনেক সময় SMS-এও আসে। না পেলে যে অফিসে জমা দিয়েছেন সেখানে যোগাযোগ করুন; অনেক ক্ষেত্রে তারা আপনার নাম/ফোন/তারিখ দিয়ে মিলিয়ে দিতে পারেন। প্রিন্টে Header/Footer অন না থাকলে ID দেখা যায় না। তাই প্রিন্ট দেয়ার সময় সেটিংস চেক করুন।
বাবা–মায়ের নম্বর নেই, আবেদন আটকে যাচ্ছে
এখন সিস্টেমে সাধারণত বাবা–মায়ের ডিজিটাল রেকর্ড চাওয়া হয়। আগে তাদের রেকর্ড ঠিক আছে কি না দেখে নিন। না থাকলে প্রথমে তাদের রেকর্ড/নম্বর অনলাইনে তোলা লাগে, তারপর সন্তানের আবেদন দিন। ২০০০ বা তার আগে জন্ম হলে কখনো কখনো নাম টাইপ করার অপশন পাওয়া যায়, আপনার কেসে যা আসে সেটাই ফলো করুন।
৪৫ দিনের সময় পেরিয়ে গেছে
তবু করা যায়, তবে “লেট রেজিস্ট্রেশন” হিসেবে অতিরিক্ত কাগজ/ফি লাগতে পারে। যাই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবেদন দিন। আইন অনুযায়ী ৪৫ দিনের মধ্যেই করা উত্তম।
প্রিন্ট কপি/কাগজ ১৫ দিনের মধ্যে জমা দিইনি
এই ক্ষেত্রে আবেদনটি সিস্টেমে বাতিল হয়ে যেতে পারে। নতুন করে আবেদন করতে হতে পারে। তাই আবেদন দিয়েই দ্রুত প্রিন্ট কপি ও কাগজ জমা দিন।
স্ট্যাটাসে Rejected দেখাচ্ছে
সরাসরি আপনার স্থানীয় রেজিস্ট্রারের অফিসে যান। কেন রিজেক্ট হয়েছে জেনে, যা যা লাগবে তা ঠিক করে আবার সাবমিট/জমা দিন। স্ট্যাটাস চেক করার লিংক আলাদা পোস্টে থাকবে।
FAQ
পুরোটা কি ঘরে বসেই করা যায়?
বেশিরভাগ ধাপ অনলাইনে হয়। জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফরম পূরণ, সাবমিট, জন্ম নিবন্ধন আবেদন পত্র প্রিন্ট, সব করা যায়। তবে কাগজ যাচাই ও রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয় স্থানীয় কার্যালয়ে; সেখানে প্রিন্ট কপি ও ডকুমেন্ট জমা দিতে হবে।
বিদেশে থাকি, আমার সন্তানের জন্য কীভাবে করবো?
অনলাইনে আবেদন করবেন একইভাবে; পরে নির্দিষ্ট বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশন প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে প্রসেস সম্পন্ন করবে। নিয়ম জায়গা ভেদে একটু আলাদা হতে পারে, আগে ওয়েবসাইট/ফোনে জেনে নিন।
অনলাইনে সনদের সত্যতা কীভাবে মিলাবো?
সরকারি everify.bdris.gov.bd-এ ১৭ ডিজিট নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে মুহূর্তে যাচাই করতে পারবেন।
প্রিন্ট দিলে Application ID দেখা যাচ্ছে না কেন?
বেশিরভাগ ব্রাউজারে ডিফল্টে Headers and Footers অফ থাকে। More settings → Headers and Footers অন করে আবার প্রিন্ট নিলেই ID দেখা যাবে।
৫ বছরের বেশি বয়স হলে কী আলাদা লাগে?
হ্যাঁ, বয়সপ্রমাণের জন্য অতিরিক্ত কাগজ লাগে। যেমন স্কুলের সনদ, ডাক্তারের বয়সপ্রমাণ ইত্যাদি। আপনার এলাকার অফিস যে তালিকা বলবে সেটাই দিন।
শেষ কথা
নতুন জন্ম নিবন্ধন আবেদন করতে দেরি না করে আজই শুরু করুন। আগে bdris.gov.bd-এ গিয়ে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন আবেদন দিন, তারপর জন্ম নিবন্ধন আবেদন পত্র প্রিন্ট করে নিন। প্রিন্টে Application ID যেন থাকে সেটা দেখে নিন। ১৫ দিনের মধ্যে স্থানীয় অফিসে কাগজ জমা দিন, এবং প্রয়োজনে স্ট্যাটাস দেখে নিন। সবশেষে সনদ হাতে পেলে eVerify-এ একবার চেক করে রাখুন।
ব্যক্তিগত পরামর্শঃ নামের বানান (বাংলা–ইংরেজি) শুরুতেই ফাইনাল করে নিন, বাবা–মায়ের নম্বর/রেকর্ড আগে যাচাই করুন, আর ঠিকানার অংশে ধীরে সুস্থে সিলেকশন করুন। সময়মতো করলে বাড়তি ঝামেলা, দৌড়ঝাঁপ আর খরচ সবই বাঁচবে।
নোট: উপরের ধাপগুলো সরকারি সাইটের বর্তমান ফ্লো অনুযায়ী সাজানো। আপনার লোকাল অফিসে কাগজপত্রের লিস্ট সামান্য ভিন্ন হতে পারে। জমা দেওয়ার আগে একবার ফোনে কনফার্ম করে নিলে সবচেয়ে ভালো।
